কক্সবাজার জেলা কারাগারে বন্দি আত্মস্বীকৃত শীর্ষ ইয়াবা কারবারি শাহজাহান আনসারী এবং টেকনাফের শীর্ষ ইয়াবা কারবারি এনামুল হক এনাম গ্রুপের মধ্যে মারামারি ঘটনা ঘটেছে।
কারাগারে সীট, খাবার বেচা কেনা ও টাকার লেনদেন নিয়ে সৃষ্ট ঘটনায় কারাগারে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। খবর কারাগারের একটি নির্ভরশীল সুত্রের।
২৩ এপ্রিল বৃহস্পতিবার দুপুরে এঘটনা ঘটেছে।
তবে কারা সুপার মোকাম্মেল হোসেন দাবি করেন, টাকা লেনদেন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে উভয়ের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। কেউ আহত হননি।
জানা গেছে, গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারী টেকনাফ পাইলট হাইস্কুল মাঠে আয়োজিত আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর কাছে ইয়াবা ও অস্ত্র জমা দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ও আত্মস্বীকৃত ১০২ ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করেন।
আত্মসমর্পণ করা ১০২ ইয়াবা ব্যবসায়ীর মধ্যে ২৯ জন ইয়াবা গডফাদারও রয়েছেন। আত্মসমর্পণের পর তাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে পুলিশের হেফাজতে নেয়া হয়। আত্মসমর্পণকালে তারা ৩ লাখ ৫০ হাজার পিস ইয়াবা ও ৩০টি দেশীয় অস্ত্র জমা দেন।
আত্মসমর্পণের পর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন দুই শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী। তারা হলেন- টেকনাফ সদরের ইউপি সদস্য বহুল আলোচিত এনামুল হক ও মো. সিরাজ।
এঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের করেন। ওইদিন ১০২ ইয়াবা কারবারীকে আদালতের মাধ্যমে কক্সবাজার জেলা কারাগারে প্রেরণ করেন। সেই থেকে তারা কারাগারে আছেন।
এদিকে, একটি নির্ভরশীল সুত্রে জানা গেছে, কারান্তরীন শীর্ষ ১০২ ইয়াবা কারবারির মধ্যে কক্সবাজার সদরের বাসটার্মিনাল লারপাড়ার বাসিন্দা ইয়াবা গডফাদার শাহজাহান আনসারী এবং টেকনাফ সদর ইউপি সদস্য এনামুল হক দুটো গ্রুপ সৃষ্টি করেন কারাগারে। এক গ্রুপে ১৮ জন এবং আরেক গ্রুপে ২০ জন।
এই দুটি গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার, সীট ও খাবার বেচা কেনা এবং টাকার লেনদেন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ২৩ এপ্রিল বৃহস্পতিবার দুপুরে মারামারি এবং হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। সেই সময় পুরো কারাগারে বন্দীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আতংক। উভয় পক্ষে ১০/১২ জন আহত হয়েছে বলে একটি সুত্র নিশ্চিত করেছে।
কক্সবাজার জেল সুপার মোকাম্মেল হোসেন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, কারা পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে আছে। কেউ আহত হয়নি। উভয় পক্ষকে নিয়ে মিমাংসা করা চেস্টা করা হয়েছে।
সচেতন মহলের মতে, কক্সবাজার জেলা কারাগারের বন্দী রয়েছে অন্তত দেড় শতাধিক ইয়াবা গডফাদার। তারা সেখানে সিন্ডিকেট করে আয়েশি জীবন কাটাচ্ছে। কেউ কেউ গ্রুপ সৃষ্টি করে জেলের ভেতর বিভিন্নভাবে বাণিজ্যেও মেতেছেন।
বর্তমানে কারাগারে যেসব কয়েদি ও হাজতি রয়েছে সেখানে অন্য আসামিদের তুলনায় ইয়াবা মামলার আসামিই বেশি।
সূত্র জানায়, নগদ অর্থ ছাড়া বর্তমানে কারাগারে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা দূরের কথা, জীবন বাঁচানোর পানি পর্যন্ত মিলে না বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। হাসপাতাল ও নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী নিয়েও চলছে হরিলুট।
সম্প্রতি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া এক জনপ্রতিনিধি জানান, যতদিন কারাগারে ছিলাম ততদিন লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালে থাকার জন্য নগদ টাকার পাশাপাশি অনেক সুবিধা দিতে হয়েছে। হাসপাতালের দুর্নীতির অভিযোগের শেষ নেই।
সীমান্ত উপজেলা ও ইয়াবা শহর নামে পরিচিত টেকনাফের বড় বড় ইয়াবা গডফাদাররা কিনে নিয়েছে হাসপাতালের সিট।
ইয়াবা মামলার আসামিরা দখলে নিয়েছে হাসপাতাল।
হাজতি ও কয়েদিদের দেখার ঘর, নিত্যদিনের খাবার, সাজাপ্রাপ্তদের কাজকর্ম বণ্টন, বিভিন্ন ওয়ার্ডের সিট ব্যবসা, কারাগারের ভেতরে পিসি নামের দোকান, গোসল ও খাবার পানির সরবরাহ ব্যবসাসহ আরও একাধিক সেক্টর নিয়ে প্রতিদিন ও প্রতি মাসে রমরমা নানা বাণিজ্য করে যাচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে, প্রতি মাসে কক্সবাজার কারাগার থেকে অবৈধ পথে আয় হয় ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা। কোনো ইয়াবা ব্যবসায়ীর জামিন হলেই আর কোনো কথাই নেই। কারাগার থেকে বের হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুনরায় ধরে নিয়ে যাওয়ার হুমকি-ধমকি দিয়ে নিরাপদে বের করে দেয়ার প্রতিশ্রুতিতেই আদায় হয় লাখ লাখ নগদ অর্থ।
কারাগার থেকে গত দুই আগে মুক্তি পাওয়া এক ব্যক্তি জানান, কারাগারে না ঢুকলে কখনও দুর্নীতির বর্ণনা দেয়া যাবে না। কারাগার একটি আলাদা জগৎ। ওই জগতে সব মিলে। তবে বিনিময়ে শুধু অর্থ।
টাকা দিলে ঘরোয়া পরিবেশে বসে মোবাইলের মাধ্যমে পুরো দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করাও সম্ভব। একইভাবে জেল ফেরত আরেক হাজতি বলেন, কারাগার সাধারণ মানুষের জন্য। তাদের সবকিছু নীরবে সহ্য করতে হয়। কারণ রোগী থাকে হাসপাতালের মেঝেতে বা ওয়ার্ডে।
ইয়াবা ব্যবসায়ীরা থাকে হাসপাতালের সিটে। মুমূর্ষু কোনো রোগী যদি হাসপাতালে থাকে তাহলে তাকে প্রতি মাসে ফার্মাসিস্টকে নগদে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে পরিশোধ করতে হয়। তা হলে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে কত টাকা নেয় এটা বুঝতে বাকি থাকে না।
কারাগারের পরিবেশ শান্ত ও ভাবমূর্তি রক্ষার্থে কারান্তরিন শীর্ষ ১০২ ইয়াবা কারবারিদেরকে দেশের বিভিন্ন কারাগারে স্থানান্তর খুব জরুরী হয়ে পড়েছে। শীর্ষ ইয়াবা কারবারীদেরকে কারাগারে একই জায়গায় রাখায় তারা কেউ কাউকে ছাড় দেয় না, ইয়াবা টাকার গরমে প্রতি নিয়ত চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি হচ্ছে।
এধারা অব্যাহত থাকলে সামনে বড় কোন দূর্ঘটনা সামাল দিতে ব্যর্থ হতে পারেন কারা কর্তৃপক্ষ, এমন আশংকাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না সচেতন মহল।