মিজানুর রহমান মিজান।
সেইসময় নুসরাত কী করেছিল জানেন? সাহসী তেজস্বিনী নুসরাত সেই আহত অবস্থাতেও হাসপাতাল বেড থেকে উঠে আবার এসেছিল পরীক্ষা দিতে।
নুসরাতের মা তখন বলেছিল, চোখে প্রচন্ড জ্বালাপোড়া থাকা সত্বেও নুসরাতের আগ্রহের কারনে আমরা চট্রগ্রাম থেকে তাকে পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে নিয়ে এসেছি। পরীক্ষা শেষে পূনরায় চিকিৎসার জন্য তাকে চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে যাবো।
সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী অফিসার এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘আমি আশ্চর্য হয়েছি চোখে প্রচন্ড জ্বালাপোড়া নিয়ে নুসরাত সাহসিকতার সঙ্গে পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে ,আমরা নুসরাতের পাশে আছি থাকবো’
সোনাগাজী থানার ওসি ভরসা ভরসা দিয়ে বলেছিলেন, ঘটনার সাথে জড়িতদের আটকের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কথা পর্যন্তই, আর কিচ্ছু হয়নি। কেউ আটক হয়নি। নুসরাত বিচার পায়নি সেই ঘটনায়।
নুসরাতের বয়স তখন ছিল মাত্র ষোল বছর। কিশোরী নুসরাত আইনি সহায়তা পায়নি, বিচার পায়নি, মিডিয়া নুসরাতের পাশে এসে দাড়ায়নি।
কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামের ষোল বছর বয়সী নুসরাত একাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করবার শক্তি দেখিয়েছিল। চোখ হারানোর সম্ভাবনা নিয়েও সে পুনরায় পরীক্ষা কেন্দ্রে এসে বলেছিল, তোমরা আমাকে হারাতে পারবে না। এই দেখ, আমি আবারো ফিরে এসেছি।
দুইবছর পর, ২০১৯, মার্চ আবারো নুসরাতের উপর যৌন নির্যাতন হয়। প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ তাঁর ছাত্রী নুসরাতকে নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে যৌন নির্যাতন করেন।
ষোল বছরে যে নুসরাত একদল বখাটের বিরুদ্ধে একা লড়াই করেছিল, সে আঠারোতে তার উপর ঘটিত যৌন নির্যাতনে চুপ করে থাকবে? নুসরাত চুপ থাকেনি। সে থানায় গিয়ে অভিযোগ করে ক্ষমতাবান অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে।
থানার ওসি নুসরাতকে নিয়ে আপত্তিকর ভিডিও করল, অনলাইনে সেই ভিডিও ছেড়ে মানসিকভাবে তাকে দ্বিতীয়বার লাঞ্ছিত করল। এলাকায় নুসরাতের নামে গীবত রটানো হল। অধ্যক্ষের পক্ষে এলাকার বড় বড় নেতা, মাদ্রাসা কমিটি, স্থায়ীয় প্রভাবশালীরা অপরদিকে নুসরাত একা। এমনকি নুসরাতের বান্ধবীরা তাকে ফেলে চলে গেল। তারা অধ্যক্ষের মুক্তির জন্য মিছিল করল।
একা নুসরাত তার ডায়েরিতে লিখল – ‘আমি লড়ব শেষনিশ্বাস পর্যন্ত। মরে যাওয়া মানেই তো হেরে যাওয়া। আমি মরব না। আমি বাঁচব। আমি তাকে শাস্তি দেব, যে আমায় কষ্ট দিয়েছে। আমি তাকে এমন শাস্তি দেব যে তাকে দেখে অন্যরা শিক্ষা নেবে।’
এত ঝড় এত আঘাত, তবুও নুসরাত পড়াশোনা বন্ধ করেনি। সে সময় মত পরীক্ষা দিতে আসল। নুসরাত পরীক্ষা কেন্দ্রে গেলে তাকে ছাদে নিয়ে মামলা তুলে নিতে বলা হল নতুবা আগুনে পোড়ানোর ভয় দেখানো হল। নুসরাত তবুও মামলা তুলবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিল। নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
আশি ভাগ পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে হাসপাতালে শুয়ে নুসরাত কী বলল জানেন?
সে বলল, ‘আমি সারা বাংলাদেশের কাছে বলব, প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলব, সারা দুনিয়ার কাছে বলব, এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করব।’
হাসপাতালের বেডে নুসরাত তাকে উন্নত চিকিতসার জন্য বিদেশে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেনি, সে বেচে থাকার আকুতি জানায়নি, নুসরাত সারা দেশবাসীর কাছে নিজের জন্য দোয়া কামনা করেনি।
নুসরাত শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বলেছিল, ‘প্রতিবাদ করব’
এই ঘুণে ধরা সমাজের বিরুদ্ধে অষ্টাদশী নুসরাত একা লড়াই করেছে।
নুসরাত তার ডায়েরিতে মৃত্যুর দিন কয়েক আগে লিখেছিল – যদি তোর ডাক শোনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে
জীবিত নুসরাতের লড়াই ছিল একার, কিন্তু মৃত নুসরাতের সেই প্রতিবাদকে গিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায় আমাদের প্রতিটা মানুষের।
কারন নুসরাত হেরে গেলে যে আমরাও হেরে যাবো
‘প্রতিবাদ করব’
#JusticeforNusrat