যুক্তরাষ্ট্র থেকে
…✍ মুহাম্মদ ইদ্রিস হোসাইন আকাশ
৯০ দশকের দিকের কথা, প্রতি রমজানের ২৬ কিংবা ২৭ রোজাতে ছোট চাচা ঈদের কেনাকাটার জন্য বিকেল টাইমে কক্সবাজার রওনা দিতো আর সে সময় প্রায় আমি ছোট চাচার সাথে যেতাম।
সে দিনগুলো ছিলো অসাধারণ বিশেষ করে উপভোগ করতাম ঈদের বাজারে ঘুরাফেরা, মুদির দোকানে কেনাকাটা, ঈদের নতুন জামা কেনা এবং সব শেষে মধুবন বেকারী বা চৌরঙ্গীতে বসে ইফতার। আমার এখনো মনে আছে ছোট চাচার সাথে সেই ইফতারের দৃশ্য, ইফতার নিয়ে অপেক্ষা অতঃপর সময় হলে পাশের ফায়ার সার্ভিস অফিস থেকে বিকট একটি শব্দ আসতো। আর এই শব্দের সাথে সাথে সবাই ইফতার শুরু করতো। ইফতারের পর আবার ব্যস্ত কেনাকাটা….
সবশেষ মধুবন থেকে হালিম খেয়ে বদুখুলুর(আমাদের পরিচিত ট্যাক্সি চালক) বেবি ট্যাক্সিতে রওনা দিতাম ভালুকিয়ার উদ্দ্যেশ্যে। বাসায় এসে কি আনন্দ আমার ঈদের জামা সবাইকে দেখাতাম কিন্তু কাউকে স্পর্শ করতে দিতাম না…কারণ প্রচলিত ছিলো ঈদের জামা কেউ স্পর্শ করলে নাকি পুরাতন হয়ে যায়।
অবশ্যই ঈদের আগেরদিন আম্মু নতুন কাপড় ধুয়ে রোদে শুকাতে দিতো। পরে কাপড় ইস্ত্রি করে টেবিলের উপর রেখে দিতো আর আমি সেটি নিয়ে জড়িয়ে ধরে সারারাত ঘুমিয়ে থাকতাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার আগে গোসল করে ঈদগাঁও যাওয়ার জন্য তৈরি হতাম। নতুন কাপড় পরিদান করে শরীরে আতর মেখে সবাই মিলে রওনা দিতাম থিমছড়ি ঈদগাঁও মাঠে।
ঈদগাঁও মাঠে যাওয়ার পর কি যে আনন্দ তা বলে প্রকাশ করা যাবেনা। বিশেষ করে যে ছোট ছোট খেলনা, শরবত, খাবারের দোকান বসত সেগুলো উপভোগ করতাম।
কিছুক্ষণ পর নামাজের তাগবির শুরু হয়ে যেত….. আমাদের সকলের অতি পরিচিত ফিরোজ কাকার ঈমামতিতে ঈদের নামাজ শুরু হয়ে যেত……
নামাজ শেষে বাসায় এসে সবার কাছ থেকে ঈদি সংগ্রহ পর্ব শুরু হতো। ৫ টাকা ১০ টাকার এমন করে ১০০ টাকা পর্যন্ত ঈদি পেতাম। আর বন্ধুরা মিলে পাড়ার ছোট ছোট দোকান থেকে বিভিন্ন জিনিস কিনে খেতাম… মজার বিষয় ছিলো এই ঈদি গুলো অনেকদিন পর্যন্ত স্বযত্নে রাখতাম…..ঈদের দিন খরচের পর বাকি টাকা আম্মুর কাছে জমা রাখতাম। সে সময় সবচেয়ে আরেকটি মজার বিষয় ছিলো যে.. আম্মুর কাছ থেকে সারা বছর এই ঈদির টাকা নিতাম…. শেষ হয়ে গেলেও কখনো শেষ হতো না ঈদির টাকা… আম্মু বকা দিয়ে বলতো আগামী ঈদে আমার কাছে ঈদি জমা রাখবিনা…..তোর জমা রাখা ঈদি কবে শেষ হয়ে গেছে আবার এখনো ঈদি চাইতেছিস…
তবে বকা দেওয়ার ঠিক একটুপর আবার ঈদি দিয়ে দিতো….. একেই বলে মমতাময়ী মা… ঈদি শেষ হলে কি হবে মায়ের মমতার ভান্ডার তো আর শেষ হয়না…।
কি জীবন….এই সামান্য ঈদির টাকা থেকেই সেইসময় অসামান্য আনন্দ পেতাম। আর এই ঈদির টাকা আমার হাতে দিয়েই আম্মুও অনেক খুশি হতো। আম্মুর সেই খুশি ঝলমলে চেহারাটা এখনো আবার চোখে ভাসে।
মাঝে অনেকগুলো ঈদ চলে গেছে। সেই আমি ছোট থেকে বড় হয়েছি। এখন সংসারের অনেকটা দায়িত্ব এসে পড়েছে আমার উপরে।
এখন আমি আর ছোট চাচার সাথে কক্সবাজারে ঈদের কেনাকাটা করতে যায় না, বরং সময়ের বিবর্তণে এখন আমি নিজেই অন্যের জন্য কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত।
তবে এখন মাঝে মাঝে একমনে চিন্তা করি এবং ভালো করে বুঝতে পারি যে বড় হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ঈদের আনন্দটা হারিয়ে যায় এবং ঈদটা শুধু দায়িত্বে পরিনত হয়ে যায়। ঈদের আনন্দটা কেবল শুধু ছোটদেরই জন্য।
সত্যি, এখনও যখন ঈদের কথা ভাবি, চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমার শৈশবের সেই ভালোবাসাময় সাদামাটা ঈদ।
আমরা জানি ঈদ মানে আনন্দ, উৎসব ও আয়োজন। তবে এ বছর ঠিক বিপরীত একটি ঈদ উদযাপন করতে যাচ্ছি আমরা। বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের জন্য এমন বিবর্ণ একটা ঈদ এসেছে, যা আগে কখনো আসেনি।
অদ্ভুত এক অন্ধকারে ঢেকে গেছে পৃথিবী। চারিদিকে মৃত্যু, ক্ষুধা আর হাহাকারের মিছিল। কাছাকাছি না থেকে দূরে থাকারও দিন এসেছে।
নিদানকালের এই ঈদে তাহলে আমরা কী করতে পারি?
মেজভাই কিছুদিন আগে ধারণা দিল, যেহেতু ঈদে অন্যের বাড়িতে যাওয়া যাবে না, ভাইবোনেরা সবাই মিলে ওয়াটআপসে গ্রুপ ভিডিও চ্যাট এর মাধ্যমে সংযুক্ত হতে পারি সকাল সকাল। ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে আবার না হয় ঢুকে যাব দৈনন্দিন কাজে।
যারা করোনা মাথায় করে ঈদের কেনাকাটা করেছেন, তারা অনলাইনেই বন্ধুদের কাপড়-মেকআপ দেখিয়ে দিতে পারেন। খামোখা বন্ধুর বাড়ি গিয়ে করোনা ছড়িয়ে লাভ নাই।
ডিজিটাল এই দুনিয়ায় আপ্যায়ন, গল্প, ডেটিং, শুভেচ্ছা ও উপহার বিনিময় সবই চলতে পারে ভার্চুয়ালি। টিভিতেও থাকছে না বিশেষ কোনো ঈদ আয়োজন।
এমনকি কোনো স্কুল যদি মনে করে ঈদের এই ছুটিতে একটা পরীক্ষা নিয়ে ফেলবে অনলাইনে, তাও তারা পারবে। কারণ ঈদের ছুটির হিসাব কষার সেই উত্তেজনা এখন আর কেউ বোধ করছেন না।
আর তাই প্রথমবারের মতো সংবাদপত্রও ৬ দিন বন্ধ দিয়ে দিল। এমনিতেই আমাদের জীবনে ঈদের আনন্দ হালকা হয়ে আসছিল, এর মধ্যে এরকম একটি নিরানন্দময় ভার্চুয়াল ঈদ আমাদের আরও দূরে সরিয়ে দিল যেন।
অথচ ছোটবেলায় ঈদের দিনটি যতো এগিয়ে আসত, আমাদের আনন্দ ততই বেড়ে যেত। শুধু ভাবনা ছিল নতুন কাপড় পরে পাড়া বেড়ানো আর মজার মজার খাবার খাওয়া। আমরা শুধু দুই ঈদেই ভালো কাপড় ও জুতা পেতাম। ঈদে কার জামা কেমন হবে, তা লুকানোর জন্য ছিল পড়িমরি চেষ্টা।
আমাদের ছোটবেলায় এত চাকচিক্য ছিল না। অনেক না পাওয়ার মধ্যে তাই ঈদের এই পাওয়াটা ছিল অনেক বেশি কিছু।
এখন যেমন ঈদ উপলক্ষে মেয়েদের মধ্যে নতুন গয়নাগাটি, শাড়ি, কাপড়, পর্দা, চাদর, হাড়ি-পাতিল, ক্রোকারিজ- কোনো আইটেমই কেনাকাটা থেকে বাদ যায় না। কিন্তু, তখন অবস্থাটা সেরকম ছিল না। তবে কেমন ছিল সে সময়ের ঈদের দিনের গৃহসজ্জা?
আম্মু এবং মেজআপুকে দেখতাম ঈদের চার-পাঁচ দিন আগে বাসার চাদর, টেবিল ক্লথ, সোফার কভার, পর্দা সব ধোলাই করতো। ওই কয়েকটা দিন আমাদের বেশ আবরণহীন অবস্থায় থাকতে হতো। সবকিছু ধুয়ে, কড়া করে মাড় দেওয়া হতো। ঈদের আগের রাতে আমরা বসে বসে ঘরের পর্দা লাগাতাম, সোফার কভার ভরতাম। আর মেজভাই পুরনো জিনিস নতুন করে রং দিয়ে সাজানোর কাজে ব্যস্ত থাকতো। সে এক অন্যরকম আনন্দ ছিল।
কোটবাজার থেকে বিভিন্ন রঙ্গিন কাগজ কিনে কাগজের ফুল তৈরি করে ঘর সাজাতাম। ঈদ উপলক্ষে আম্মা কুরুশ কাঁটার টেবিল ক্লথ, ড্রেসিং টেবিলের ঢাকনা- এসব বুনতে বসে যেত। আর আপুরা পুরনো চাদরে নতুন করে ফুল তুলত, কাট ওয়ার্কের কাজ করত। ৯০-এর দশকে এরকম ঈদ অভিজ্ঞতা আমাদের উখিয়াতে এখন আর তেমন দেখা যায়না।
ঘর সাজানোর পর শুরু হতো রান্নার আয়োজন। ঈদের দিন ভোর থেকে রান্নার গন্ধে ঘুম ভেঙে যেত সেমাই, জর্দা, পোলাও, কোরমার গন্ধ। আমরা ঘুম থেকে ওঠার আগেই আম্মা টেবিলে খাবার সাজিয়ে ফেলতেন। আম্মার বহু শখের ক্রোকারিজগুলো সেদিনই শো-কেস থেকে বের করা হতো।
ছোটচাচা, আমি বড়ভাই, মেজভাই, সেজভাইসহ সবাই নামাজ থেকে ফিরে এসে একসঙ্গে বসে সেমাই খেতাম এবং তারপরই নতুন কাপড় পরে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়িয়ে পড়তাম।
আমি শুরুতেই বলছিলাম যে রোজার ঈদের আরেকটা বড় আকর্ষণ ছিল ঈদির টাকা। দু’দশ টাকা করে ১০০ টাকার মতো ঈদি পেতাম। অন্যান্য দিন যা যা কিনে খেতে পারতাম না, তাই খেতাম বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে। যতদিন এই টাকা হাতে থাকত, ততদিন নিজেকে রাজা রাজা মনে হতো। রাতের খাবার খেয়েই বসে যেতাম বিটিভি’র সামনে ঈদের আনন্দমেলা ও নাটক দেখতে।
আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের আজকালের ঈদ এবং আমাদের ছোটকালের ঈদের সবকিছুর মধ্যেই অনেক ফারাক হয়ে গেছে। তখন ঐশ্বর্য ছিল কম; কিন্তু আনন্দ ছিল বেশি। আমরা অনেক কিছু পেতাম না; কিন্তু যা কিছু পেতাম, তা তারিয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতাম।
আজকালকার শিশুরা এত জামা-কাপড় পায়, এত খেলনা, খাওয়া দাওয়া পায় বলে হয়তো ঈদের জামা-জুতো কেনার আনন্দটা তারা সেভাবে উপলব্ধিই করতে পারে না।
যাহোক, এ বছর ঈদে করোনার কারণে দিন-রাত এক করে কেনাকাটা করা, চাঁদ রাতে ঘুরে বেড়ানো, বাজি ফুটানো, নতুন কাপড়-আসবাবপত্র-গৃহের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা, ঈদের উপহার দেওয়া-নেওয়া, গ্রামে যাওয়া, বাবা মায়ের কাছে ফেরা, শহরময় ঘুরে বেড়ানো, দেশে-বিদেশে ছুটি কাটাতে যাওয়া সব বন্ধ। এমনকি ক্ষমতা থাকলেও আমাদের উচিত হবে না কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া।
শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অনেকগুলো দেশেরই মুসলিম নেতৃবৃন্দ বলেছেন সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে হবে বলে ঈদ করতে হবে ভার্চুয়ালি। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সৌদি আরব, মিশর, জর্ডান, তুরস্ক সবখানেই ঈদ হবে অনেকটাই ঘরবন্দি অবস্থায় এবং কোথাও কোথাও কারফিউয়ের মধ্যে। কাজেই সবাই মিলে এই দুঃখ পুষিয়ে নেওয়া যাবে!
যারা চাকরি করেন, তাদের জন্য সবচেয়ে বড় আনন্দ ঈদ বোনাস পাওয়া। এবার সেই বোনাসের উপরেও চাপ পড়েছে। কেউ পাচ্ছেন, কেউবা অর্ধেক পাচ্ছেন, আর কেউবা পাচ্ছেনই না। কেউ কেউ তো গত দুইমাসে কোনো আয়ই করেননি।
সেইসব মানুষের ঈদ কোথায়?
দেশে অগণিত দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ আজ পেটপুরে খেতে পারছেন না। কোথাও কোনো কাজ নেই তাদের। দিনে দিনে আরও অনেক মানুষ বেকার হবেন। এই করোনার মধ্যেই আম্পান ঝড়ে উপকূলের মানুষ হয়েছেন গৃহহীন, সম্বলহীন।
যেহেতু ঈদের সামাজিক আনুষ্ঠানিকতার ব্যয় আমাদের কমে গেছে, এখন উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ যদি কিছু দান করেন, তবেই নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের মুখে কিছু হাসি ফুটবে। এক্ষেত্রে আপনারা মানবতার কল্যাণে চাটগাঁ – The Welfare of Humanity Chattogram সংঘঠনটির সাথে সংপৃক্ত হতে পারেন।
অসহায় মানুষ যদি আপনার দেওয়া টাকায় দু’গ্রাস ভাত মুখে তুলতে পারেন বা একজন মানুষও যদি তার বাড়িভাড়ার টাকাটা দিতে পারেন বা ঝড়ে উড়ে যাওয়া চালটা ঠিক করতে পারেন বা একটা গরু-ছাগল কিনতে পারেন, তবে সেটাই হবে আমাদের জন্য অনেক পাওয়া।
শৈশবে অল্প কিছু নিয়ে আমরা তৃপ্ত ছিলাম। সবাই সমানভাবে একসঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতাম।
অথচ মাঝখানে আমরা অনেকটাই বদলে গিয়েছি। ঈদ মানেই ছিল বিলাসী ব্যয়। যারা পারছে তারাও করছে, যারা পারছে না তারা ছিনিয়ে নিয়ে করছে।
এই করোনার কারণে সৃষ্ট অভাব আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিল ‘সাধ্যের বাইরে যে সাধ তা কালে পূরণ হবার নয়, সাধ্যের মধ্যেই আছে সকল সত্য।’
আসুন সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচি। আর সেটাই হবে এই করোনা আক্রান্ত পৃথিবীতে ভার্চুয়াল ঈদের আনন্দ।
লিখেছেন…✍
মুহাম্মদ ইদ্রিস হোসাইন আকাশ
প্ল্যানো || যুক্তরাষ্ট্র ||